রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পুতিনের টার্গেট ওডেসা বন্দর

হাওর বার্তা ডেস্কঃ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মূল চরিত্র রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এই যুদ্ধ থেকে তিনি কী অর্জন করতে চান তা খোলাসা করেননি। পুতিন কী চান তা জানতে কৌতূহলী পশ্চিমা কূটনীতিক থেকে মিডিয়া-সবাই। কেননা তিনি এই যুদ্ধকে কতটা বিস্তৃত করবেন, এটা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হবে কিনা এসব প্রশ্ন চারদিকে। এতসব প্রশ্নের মাঝে একটি বিষয় ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে। তা হলো ন্যাটোর সম্প্রসারণ ঠেকানোর জন্য কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ ওডেসা বন্দর নিয়ন্ত্রণে নেওয়া পুতিনের টার্গেট বলে আপাতত মনে হচ্ছে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের আমল থেকেই ইউক্রেনের দক্ষিণে ওডেসা বন্দর বাণিজ্যের জন্য সুপরিচিত। ২০১৪ সালে গণভোটের মাধ্যমে ক্রাইমিয়া রাশিয়ার অধীনে যায়। ক্রাইমিয়া একটি উপদ্বীপ। রাশিয়ার সঙ্গে স্থলভাগে তার কোনো সংযোগ নেই। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দোনেস্ক ও লোহানস্ক স্বাধীন বলে ঘোষণা দেওয়ার পর রাশিয়া ওই দুই অঞ্চলকে স্বীকৃতি দেয়। আগে থেকে রুশ বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলে এবার রাশিয়ার সৈন্য প্রবেশ করেছে। ফলে ওই অঞ্চলটি রাশিয়ার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ওই অঞ্চল দিয়ে ক্রাইমিয়ায় যাওয়ার জন্য প্যাসেস পেলো রাশিয়া। এখন ওডেসা বন্দর নিয়ন্ত্রণে নিতে পারলে ইউক্রেন হবে স্থলবেষ্টিত একটি দেশ। ন্যাটোর সঙ্গে তার বাণিজ্য বন্ধ হবে। এটা হবে পুতিনের কৌশলগত বড় বিজয়। তবে এই পরিকল্পনা রুখতে রুশ বাহিনীর সম্ভাব্য হামলা মোকাবিলায় প্রস্তুত ওডেসা। সেখানে রুশ বাহিনী প্রতিরোধে নানা কার্যক্রম চলছে। ওডেসা অপেরা ও ব্যালে থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে ইউক্রেন বাহিনীর সদস্যরা গাইছেন তাদের দেশের জাতীয় সংগীত।

রাজধানী কিয়াভ ও পূর্বাঞ্চলীয় খারকিভের পর বন্দর নগরী ওডেসা ইউক্রেনের তৃতীয় বৃহত্তম নগরী। ‘পার্ল অব দ্য ব্ল্যাক সি’ নামে পরিচিত ওডেসা নগরীর আশপাশে যুদ্ধ চলছে। ওডেসায় যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের নিহত নাবিক হাদিসুর রহমানের মরদেহ মালদোভা হয়ে রোমানিয়ায় পৌঁছতে দেরি হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার ইউক্রেন থেকে আমদানির সব ঋণপত্র (এলসি) স্থগিত করার কারণ যুদ্ধে ওডেসা বন্দর এখন টার্গেট। ফলে বন্দরটির কার্যক্রম বন্ধ থাকায় বাণিজ্য বন্ধ।

কৃষ্ণ সাগরের উপকূলের ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার লক্ষ্যে পুতিনের কাছে ওডেসা দখল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ওডেসা দখলে নিতে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ সবদিকেই হামলা করছে রুশ বাহিনী। যুদ্ধের জন্য মারিউপোল, সুমিসহ অনেক শহরে বেসামরিক মানুষকে বাইরে যেতে প্যাসেজ দেওয়া হচ্ছে। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি কিয়েভকে ঘিরে। সবাই উৎকণ্ঠিত হয়ে অপেক্ষা করছে কখন কিয়েভ দখলে নেয় রুশ বাহিনী।

সম্রাজ্ঞী ক্যাথরিন ১৭০০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ওডিসা। যাকে বলা হয় রুশ সাম্রাজ্যের জহর। ওডিসার বাসিন্দারা রুশ ভাষায় কথা বলেন।

সোভিয়েত ইউনিয়নে মূল বন্দর ছিল। ইউক্রেনের তৃতীয় সর্বোচ্চ জনসংখ্যার এই নগরীর জনসংখ্যা ১০ লাখ। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন শুধু বাণিজ্যিক ও ভূ-কৌশলগত কারণেই বন্দরটি দখল করতে চায় এমন নয়; বরং পুতিনসহ অপরাপর রুশ জাতীয়তাবাদী নেতারা নয়া রাশিয়া গঠনের রূপরেখা প্রস্তুত করেছেন তাতে ওডেসা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনে ২০১৪ সালে দাঙ্গা হয়েছে। তবে ওই দাঙ্গায় ওডেসায় ৪৮ জন রুশ বিদ্রোহী নিহত হন। ইউক্রেন অভিযানে নামার আগে পুতিন বলেন, ওই দাঙ্গা যারা পরিচালনা করেছে তাদের শাস্তি দেওয়া হবে। ওই ক্রিমিনালদের নাম-ঠিকানা জানেন বলেও পুতিন উল্লেখ করেন।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলনস্কি কিছুদিন আগে এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, ‘রাশিয়া দ্রুতই ওডেসা আক্রমণ করবে। রাশিয়ানরা সব সময়েই ওডেসায় আসেন। তারা সব সময় উষ্ণতা পান। আমাদের আন্তরিকতার জবাবে এখন কী হচ্ছে! ওডেসার বিরুদ্ধে বোমা! ওডেসার বিরুদ্ধে পদাতিক বাহিনী? ওডেসার বিরুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র! এটা হবে যুদ্ধাপরাধ। এটা হবে ঐতিহাসিক অপরাধ।’

পুতিনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা পশ্চিমা বিশ্ব কঠিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বিশেষ করে রুশ তেল ও গ্যাসের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় তেলের দাম হু-হু করে বাড়ছে। দ্রব্যমূল্য ও মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে। রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের প্রধান ক্রেতা জার্মানি, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ডসহ অনেক দেশ বেশ সংকটে পড়েছে।

জেলনস্কিকে প্রথমদিকে নার্ভাস দেখালেও এখন তাকে বেশ আস্থাশীল দেখাচ্ছে। ন্যাটো থেকে সমরাস্ত্র ইউক্রেনের বাহিনীর হাতে পৌঁছেছে বলেও মনে হচ্ছে। অনেকে বিদেশ থেকে ইউক্রেন যাচ্ছেন রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। যদিও যুদ্ধের ময়দানের পুরো পরিস্থিতি এখনো স্পষ্ট নয়; তবে কঠোর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পুতিন তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর বলেই অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে। পরমাণু অস্ত্রও সতর্ক রাখছে। এই অবস্থায় পশ্চিমারা নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখলে এবং ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখলে দীর্ঘ মেয়াদে কোনো এক পর্যায়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কেননা প্রথমে যখন ইউক্রেন সীমান্তে রুশ সৈন্য সমাবেশ করা হয়েছিল; তখন অনেকে ভাবতে পারেননি যে এত বড় যুদ্ধ লেগে যাবে। ফলে পুতিন কি চান সেটা অনেকে বুঝতে পারেন না। তবে আপাতদৃষ্টিতে ওডেসা দখলে নিতে পারলে কূটনৈতিক টেবিলে বার্গেইন করার অনেক সুবিধা পাবেন পুতিন। তখন তিনি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার চাইতে পারেন। অবশ্য বর্তমানে কূটনীতিতে পুতিনের অবস্থা নাজুক। এই পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেন সেটাই দেখার বিষয়।

এদিকে ইউক্রেনে মানবিক সহায়তার সুযোগ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব আসার সম্ভাবনা রয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধ বন্ধ করে রুশ সৈন্য ফিরিয়ে নেওয়ার আহ্বান সংবলিত প্রস্তাবে রাশিয়া ভেটো দেওয়ায় সাধারণ পরিষদের অধিবেশন ডাকা হতে পারে। সেখানে কেন ভেটো দিয়েছে প্রথমে তা ব্যাখ্যা করবে রাশিয়া। তারপর অপরাপর সদস্য রাষ্ট্রগুলো বক্তব্য রাখবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর